আমি পড়তে শেখার পর যা দেখতাম পড়ে দেখতে ইচ্ছে হতো। একটা বই বা পত্রিকা বা ম্যাগাজিন পেলে অর্থ বুঝি না বুঝি মনে হতো পড়ে দেখি তো কী লেখা!
অনেক বানান পড়তেই পারতাম না, অর্থ জানতাম না। সে সব আবার বড়দের কাছ থেকে জেনে নিয়ে শিখতাম। এভাবে করে করে পড়বার একটা আগ্রহ তৈরি হলো। এরপর হয়ে গেল নেশা। আমি নিজে বাইরে দৌড়ঝাঁপ করে খেলাধুলা করিনি কখনো। সেই সুযোগ ছিল না। বাড়িতে বিছানায় বসে পুতুল খেলা আর ঐ বই আমার শৈশব।
আমাদের আর এখনকার শৈশব-কৈশোরের মাঝে পরিস্থিতিগত পার্থক্য থাকায় বইয়ের চাইতেও মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম এমন চটকদার চলমান কার্টুন, গেমস তাদের আছে। যা কিছু চোখের সামনে নাচছে, ঘুরছে, নানা রঙের সমাহার তাতে। এসব চটজলদি মনোযোগ কেড়ে নেয়। এদের চাইতে ছাপার অক্ষর কোনো দিন মজাদার, আকর্ষণীয় হতে পারে না। তাই এখনকার দিনের ছোট্টবাচ্চা বা কিশোর, কারোরই বই ভালো লাগে না।
কেউ কেউ তো বই পড়ে কী না, এটা জিজ্ঞেস করলেও বিরক্ত হয়। কেউবা প্রশ্ন করে বসে, বই পড়তে ভালো লাগার কী আছে?
তাই সন্তানকে বইয়ে আকৃষ্ট করতে একটু কৌশল না করলেই নয়। এজন্য শিশুকাল থেকেই নানা ধরনের ছোটদের বই এনে দিতে হবে। খেয়াল করে দেখেছি বাচ্চারা কমিকস বেশ পছন্দ করে। বুঝুক না বুঝুক বইয়ের ছবি দেখবে। এতেও আগ্রহ তৈরি হবে।
কথা শেখার সময়ে বই পড়ে শোনালে দেখবেন বাচ্চা মন দিয়ে শুনছে। বিভিন্ন বয়স অনুযায়ী বই কিনে দিতে হবে। পড়তে না চাইলে তাদের পড়ে শুনাতে হবে। শুরুতেই গুরু গম্ভীর লেখা নয়। মজার লেখা দিয়ে শুরু করবেন। দেখবেন আপনার সন্তান একটা ঘটনা জানার আগ্রহ কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
আপনার নিজের যদি পড়ার অভ্যাস থাকে তো বাচ্চারাও আগ্রহী হবে বলে আশা রাখা যায়। আমি আমার সন্তানকে বই মেলায় নিয়ে যাই। ওরা নিজের জন্য বই কেনে। তবে সত্যি বলছি, একটা বইও ওরা বাড়িতে এসে ছুঁয়ে দেখে না। আমি ৭/১০/১৪ দিন অপেক্ষা করে দেখেছি। ঐ কেনা পর্যন্তই। আমি এতে হাতাশ হয়েছি। তবে রাগ করিনি। বিরক্ত হইনি। একটা বই নিয়ে ওদের কাছে বসে একটু জোরে জোরে পড়লাম। বইটি ছিল সিসিমপুরের রাজা রানির কাহিনী। আড়চোখে দেখি ওরা শুনছে। এরপর বই বন্ধ করে উঠে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম, আমার মেয়ে যেহেতু পড়তে পারে, সে বইটা খুলে কোথায় শেষ করেছি, সেই পাতাটা খুঁজছে। আর আমার ছেলে বলছে, মা তো কাজ করছে তুমি আমাকে পড়ে শোনাও।
এই পড়তে পড়তে ওরা দেখলাম খুব আনন্দ পাচ্ছে। আবার বইয়ের বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।
আমি নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। টিভি আর মোবাইল গেমসের কাছে বই টিকতে পারছে না। তবে আমি চেষ্টা বন্ধ করিনি। হাল ছাড়িনি। ক্লাস টেস্টে ভালো নাম্বার পেলেও আমি বই কিনে দিই। কোনো বিশেষ দিনেও আমি উপহার হিসেবে বই কিনে দিই।
একবার বই ভালো লেগে গেলে আর চিন্তা নেই। এটা চলবেই। ডিভাইস থেকে মুক্তি মিলবে।
তাই চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। খেলনা তো কিনবেনই। সাথে একটা করে বই কিনে দিন। বাচ্চাদের বইয়ের নেশা ধরিয়ে দিন।
– মুসাররাত নাজ
(একজন টিনএজার কন্যার মা)